মানুষ মরণশীল কিন্তু তাঁর কীর্তি তাকে ‘অমর’ করে রাখে, ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে থাকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার সেই শ্রেষ্ঠ সন্তান, যাঁর বীরগাথা গাইবে এ দেশের মানুষ, শত শত বছর পরেও তাঁর কীর্তি ঘোষণা করবে তাঁরই হাতে গড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
প্রধানমন্ত্রী , তাই আপনার কাছে বিনীত নিবেদন, আপনার সরকারের প্রণীত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্মপরিকল্পনার কথা জোরালোভাবে জনগণের মধ্যে তুলে ধরুন, যাতে দেশের শত্রুরা গুজব ছড়িয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। আমলারা সব সময়ই ভালো কাজ নিয়েও লুকোচুরি খেলতে চান। জনমত তৈরিতে আমলারা বরাবরই অদক্ষ। তাদের অদক্ষতার জন্যই আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল কর্মপরিকল্পনার কথা সাধারণ জনগণ জানে না। জানে না এই মহাপরিকল্পনা তৈরি হয়েছে দেশের প্রথিতযশা নগরবিদ, ইতিহাসবিদদের প্রত্যক্ষ পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে। এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে গিয়ে উদ্যানের উদ্ভিদ আর প্রাণিকুলের কথা ভুলে যাওয়া হয়নি বরং এর বিকাশে নেওয়া হয়েছে সযত্ন পরিকল্পনা।
যেকোনো দেশের নগরায়ণ এমনকি গ্রামের বসতবাড়ি করতেও উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের কিছু না কিছু ক্ষতি তো হয়, তা অনস্বীকার্য। যেদিকটায় আমাদের পরিকল্পনাবিদদের তীক্ষ্ণ নজর রাখা উচিত, তা হচ্ছে প্রাকৃতিক সেই ক্ষতিটুকু পুষিয়ে দেওয়া এবং বিকল্প পন্থায় তার বিকাশ ঘটানো। একটি গাছ কাটলে উদ্যানের অন্য অংশে তিনটি গাছ লাগানো। অপ্রয়োজনে একটি গাছও না কাটা। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পরিবেশ ও প্রয়োজনে যেকোনো পরিকল্পনা পরিবর্তন-পরিবর্ধন উন্নয়নের পূর্বশর্ত। গণমানুষ আর দেশের মঙ্গলের জন্যই এই পরিবর্তন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর তার ছায়াঢাকা গাছগাছালি যেমন এই ঢাকা শহরের ফুসফুস আর পাখিকুলের অভয়ারণ্য, তেমনি এখানেই জাতির হৃৎপিণ্ডে প্রথম স্পন্দিত হয়েছিল ‘বাংলা’ নামের শব্দ। এই উদ্যানেই টুঙ্গিপাড়ার খোকা, গণমানুষের নেতা শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এখানেই উচ্চারিত হয়েছিল স্বাধীনতার সেই অমোঘ বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ এখানেই নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি…আমাদের হলো।’ জাতির কাছে এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিটি ধূলিকণারই তাই অনেক মূল্য।
আর দশটি উদ্যানের মতো সাধারণ উদ্যান এটি নয়। অসাধারণ সমৃদ্ধ এক ইতিহাস এর আছে। দেশে দেশে লাখো পার্ক আছে, কিন্তু একটি জাতির ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় ধরে রাখা অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী এমন উদ্যান এই পৃথিবীতে আর আছে কি না জানা নেই, থাকলেও বিরল। রেসকোর্স ময়দান হিসেবে পরিচিত এই জায়গা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে শেষ দিন অবধি ছিল ইসলামে নিষিদ্ধ ঘোড়দৌড়ের জুয়াড়িদের সরকারি আমোদখানা।
রেসকোর্স ময়দানকে ঘিরেই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় একটি অধ্যায় রচিত হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে এই উদ্যান থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো ঘোষণা দিয়েছিলেন এই ভূখণ্ডের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই উদ্যানেই এক নাগরিক সংবর্ধনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি এখানেই এক জনসভায় জনপ্রতিনিধিদের শপথ পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে এখানেই তিনি জাতিকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এখানেই পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে এখানেই বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তাঁর কান্নায় ভেঙে পড়া আবেগঘন ভাষণ। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ এক বিরাট জনসভায় এখানেই বক্তব্য দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এই উদ্যানের এক পাশেই রয়েছে জাতীয় নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধি। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বহস্তে নারকেলগাছের চারা লাগিয়ে এই ময়দানকে আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রূপান্তরিত করেন, বন্ধ করেন ঘোড়দৌড়।
১৯৯৯ সালে সরকার জায়গাটিকে আবার ইতিহাসের ধারায় ফিরিয়ে আনেন। তৈরি করা হয় স্বাধীনতার স্মারক ‘শিখা চিরন্তন’। ২০০৯ সালের ৮ জুলাই হাইকোর্ট এক রায়ে ৭ মার্চের ভাষণের স্থান এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণস্থল সংরক্ষণের নির্দেশনা দেন। রায়ে উদ্যান থেকে বিদ্যমান সব স্থাপনা অপসারণ করে চিহ্নিত স্থানগুলোয় আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে বলা হয়েছে।
২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক তৃতীয় পর্যায়ের মহাপরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু গাছ কাটা পড়েছে। সত্যিকারের পরিবেশবাদীদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, আসুন আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি করি, যাতে তারা আমাদের নিশ্চিত করেন যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি গাছও কাটা হবে না। একটি গাছ কাটা হলে তিনটি গাছ লাগিয়ে তার পরিচর্যা করে পরিবেশের ক্ষতিপূরণ করা হবে। ঘোড়দৌড়ের এই ধু ধু ময়দানে সাকল্যে ১০০টি গাছও ছিল না।
আমার বেঁচে থাকার তাগিদে অক্সিজেন চাই তবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া জাতির হৃৎপিণ্ড সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাসকে ভুলে গিয়ে নয়। আমার ফুসফুসে আমি অক্সিজেন চাই, আবার আমার হৃৎপিণ্ডে-ধমনি থেকে নতুন রক্তের স্রোতোধারাও চাই। এই উদ্যান যদি বেঁচে থাকে, সত্যিকারের ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে তবেই অনাগত বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের কথা ভুলে যাবে না। কিন্তু এই উদ্যান যদি বেঁচে থাকে কেবল ঢাকার ফুসফুস হয়ে, তবে আমি ঢাকাবাসী হয়তো বেঁচে যাব আরও কিছুকাল, কিন্তু আমার একাত্তরের অগ্নিমন্ত্রের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ মরে যাবে।
আমিও চাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছগুলো বেঁচে থাক। তবে জাতির হৃৎপিণ্ডের কথা ভুলে গিয়ে ইতিহাসের হত্যাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাই না।