ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ২০ জনকে হত্যার ঘটনার ছয় বছর পর সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ জঙ্গি-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও অনলাইনে চরমপন্থা এখনো উদ্বেগের বিষয়।
“হলি আর্টিজানের ঘটনা পুলিশি কার্যক্রমে বড়ো রকমের পরিবর্তন এনেছে। পুলিশের প্রত্যেক সদস্য বুঝতে পেরেছেন দেশের নিরাপত্তার জন্য জঙ্গিরা কতটা বিপজ্জনক।
“জনগণের সহায়তায় জঙ্গিদের নিপাত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো শক্তি দিয়ে কাজ করেছিল। বিভিন্ন অপারেশনে অনেক জঙ্গি মারা পড়ে এবং অন্যরা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মঘাতী হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর তথ্য অনুযায়ী হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি অভিযানে ৮৫ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি মারা যান, গ্রেপ্তার হন প্রায় আড়াই হাজার।
এর মধ্যে প্রায় ৬০০ অভিযানে ২৫ জঙ্গিকে হত্যা এবং দেড় হাজার জনকে আটক করে র্যাব।
এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষায়িত শাখা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রায় ৪০০ অভিযান চালিয়ে ৬০ জনের বেশি জঙ্গিকে হত্যা ও ৯০০ জনকে গ্রেপ্তার করে।
এর বাইরে হলি আর্টিজান হামলার পর দেশব্যাপী সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে গঠিত পুলিশেরে কেন্দ্রীয় সংস্থা এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) গ্রেপ্তার করে প্রায় ১০০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশ পুলিশের কার্যক্রম প্রসঙ্গে সিটিটিসির প্রধান এম আসাদুজ্জামান বলেন, “গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২২ নম্বরে। গত বছর বাংলাদেশ সেই তালিকায় ৩৩তম অবস্থানে এসেছে। তার মানে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ঝুঁকি কমেছে, আমাদের কৌশল কার্যকর হয়েছে।”
সাইবার সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মতে, জঙ্গিরা এখন স্থান নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
“ইন্টারনেট, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ছাড়া সবকিছুই এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের মতামত প্রচার করছে। আমরা যদিও সজাগ আছি, জঙ্গিরা সামাজিক মাধ্যমে এই সুযোগটা পাচ্ছে, কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
“জঙ্গিরা যোগাযোগের নানান অ্যাপসহ অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজস্ব নেটওয়ার্ক বিকাশের চেষ্টা করছে,” বলেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার অধিনায়ক খন্দকার আল মইন।
তিনি বলেন, “সাইবার জগতে তাদের কার্যক্রম রোধ করতে আমরা আমাদের সাইবার মনিটরিং সেলটি বাড়িয়েছি। হলি আর্টিজানে আক্রমণের পর এই সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যারা সাইবার স্পেস ব্যবহার করে চরমপন্থা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে তাদের আমরা সবসময় পর্যবেক্ষণ করছি।”
হলি আর্টিজানে হামলার পর পর পুলিশ প্রশিক্ষণ, উন্নত সরঞ্জাম ও জনশক্তি বাড়িয়েছে বলে জানান এটিইউ প্রধান কামরুল আহসান।
“আমরা জঙ্গি হামলার বেশকিছু প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে সফল হয়েছি। বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রায়শ গ্রেপ্তার হচ্ছে এবং তাঁদের কাছ থেকে সাইবার জগতে তাঁদের আদর্শ প্রচারের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন ডিভাইস উদ্দার করা হচ্ছে।
চলতি মাসের শুরুতে মোবাইল ফোনে আড়িপাতার স্থানান্তরযোগ্য প্রযুক্তি কিনতে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে মন্ত্রী পরিষদ।
“ইন্টারসেপ্টর নামক এই যন্ত্রটি একটি বাহনে স্থাপন করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। এই মেশিন যে স্থানে রাখা হবে সেখানকার মোবাইল টাওয়ারগুলোর মাধ্যমে ওই এলাকার সকল মোবাইল ফোনের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে এই যন্ত্র,” জানান তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা।
তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে মোবাইল ফোনের কথোপকথন শোনা যাবে ও খুদে বার্তা দেখা যাবে। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবারে কথোপকথন, খুদেবার্তা, ছবি, ভিডিও সবই দেখা সম্ভব হবে।”
জঙ্গি আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এর আগে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো এরকম আড়িপাতা যন্ত্র কিনেছিল বাংলাদেশ।
ইতিবাচক, নেতিবাচক প্রভাব
আমার মতে হলি আর্টিজান বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে।
“প্রথম পরিবর্তন হলো, বাংলাদেশিরা প্রথমবারের মতো ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সবচেয়ে কুৎসিত চেহারাটি দেখেছে। তাই, জনগণ সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিমালায় সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।
“এই হামলাটি হিংস্র চরমপন্থার হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠনের জন্য উৎসাহিত করেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল নিয়ে সশস্ত্র জঙ্গিদের দমন করেছিল।”
২০১৬’র ১ জুলাই সন্ধ্যায় পাঁচ যুবক হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলা চালায় এবং ভেতরের লোকজনকে জিম্মি করে। ঐ ঘটনায় তারা ৯ জন ইটালিয়, ৭ জাপানি, একজন ভারতীয় এবং একজন আমেরিকা ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকসহ সহ ২০ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিরা চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যার আগে অমুসলিম ও মুসলমান জিম্মিদের আলাদা করেছিল।
পরের দিন সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাফেতে অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের হত্যা করে। তার আগেই ইসলামিক স্টেট হামলার দায় স্বীকার করে এবং ওয়েবসাইটে ছবি পোস্ট করে। দুই জন পুলিশ অফিসার এবং দু’জন রেস্তোরা কর্মীসহ সব মিলিয়ে এতে মারা যান ২৯ জন। দুই রেস্তোরা কর্মীকে প্রথমে সন্দেহভাজন বলে গণ্য করা হলেও পরে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
হাসনাত করিম নামে একজনকে সন্দেহের বশে গ্রেপ্তারের পর দু’বছর আটক রাখা হলেও অভিযোগপত্রে তাঁর নাম না থাকায় ২০১৮ সালে আদালতের নির্দেশে তিনি মুক্তি পান।
হাসনাত করিম পরিবারের সাথে ঐ রেস্তোরায় তাঁর মেয়ের জন্মদিন পালন করতে গিয়েছিলেন। তবে কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছিল, তিনি হামলাকারীদের সহযোগিতা করেছিলেন; কারণ তাঁর মোবাইল ফোন থেকেই আইএস ওয়েবসাইটে হামলার ছবি পাঠানো হয়েছিল।
তদন্তকারীরা হামলার সাথে যুক্ত ২০ জনের বেশি সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল, যাদের মধ্যে এক ডজনের বেশি আক্রমণ-পরবর্তী বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন।
২০১৯ এর নভেম্বরে আদালত হামলার পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার দায়ে সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অভিযুক্ত একজনকে খালাস দেওয়া হয়।
অভিযুক্তদের কয়েকজন আদালত থেকে বের হওয়ার সময় ইসলামিক স্টেটের প্রতীক সংবলিত কালো টুপি পরা থাকলেও বরাবরই সরকার বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে।
হলি আর্টিজানে হামলাকারী পাঁচ তরুণের সবাই সুশিক্ষিত এবং সচ্ছল পরিবার থেকে আসা বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
উগ্র মৌলবাদে দীক্ষিত করার প্রক্রিয়ায় প্রথমে একজন যুবককে জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত করা হয়, তারপরে সে উগ্রপন্থী হয় এবং তারপরে সে সহিংসতা ও চরমপন্থার দিকে অগ্রসর হয়।