ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের অবজ্ঞা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি শুধু বিশেষ একটি দেশের নয়, এটি বৈশ্বিক আর আঞ্চলিক তো বটেই

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা শীর্ষক প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের চিত্র। এর বাংলাদেশ অংশে বলা হয়, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে ৯০ শতাংশই মুসলমান। ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হিন্দু। বাকিরা খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ। এদের মধ্যে সামান্য পরিমাণে শিয়া মুসলিম, আহমদিয়া ও প্রকৃতিপূজারি রয়েছে। তা ছাড়া আছে কিছু উপজাতি। প্রতিবেদনে আলোচিত হয়েছে এসব সংখ্যালঘুকে সুরক্ষা দেওয়ায় ব্যর্থতার অভিযোগ।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার দায়িত্ব কিছু কিছু ধর্মীয় উগ্রপন্থী সংগঠন স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। গত বছর তারা একটি রেস্টুরেন্টে হামলা করে মূলত অমুসলিমদের হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। এতে নিহত হন ২ পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৪ জন। উল্লে­খ্য, পুলিশ কর্মকর্তাদ্বয় মুসলমান ছিলেন। আর এ ঘটনায় বন্ধুদের ছেড়ে আসতে অস্বীকার করায় অকুতোভয় মুসলিম তরুণ ফারাজ অাইয়াজ হোসেন প্রাণ হারান। প্রাণ হারান একজন মুসলিম তরুণীও। তবে মূল বিষয়টি অসত্য নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে হিন্দুদের ওপর হামলা ও ৫০টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৫টি মন্দির। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, একটি মিথ্যা ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে এ হামলা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে খ্রিষ্টানদের ওপর ও গির্জায় হামলার অভিযোগও প্রতিবেদনে রয়েছে। সরকার এসব ঘটনা প্রতিরোধ বা ঘটনা-পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রমে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

এ অভিযোগগুলো সর্বাংশে অমূলক, এমনটাও বলা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও একটি মহল সক্রিয় রয়েছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক একটি উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশসহ অন্যত্র অমানবিক হামলা চালায়। এর সপক্ষে দেয় ইসলামের অপব্যাখ্যা। তবে বাংলাদেশে এ সংগঠনের অস্তিত্ব নিয়ে ভিন্নতর মতামত আছে। এটা সত্য, এখানেও সময়ে সময়ে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। ভিন্নধর্মাবলম্বী কিংবা ব্লগারসহ ইসলামের কোনো কোনো বিষয়ে অন্য ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী লোকেরাও তাদের হামলার শিকার হয়েছে। বাদ পড়েননি সুফিবাদী ঘরানার লোকজনও। এগুলো কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে সরকার এ ধরনের সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। হতে পারে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা ও আইনি সীমাবদ্ধতায় তদন্ত ও বিচার ক্ষেত্রবিশেষে বিলম্বিত হচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং তাদের উপাসনালয়ের ওপর হামলার বিষয়ও সরকার উপেক্ষা করেনি।

উল্লেখ করতে হয়, মুসলিম জনগোষ্ঠীর দুর্বল ব্যক্তি, পরিবার কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে একটি সামাজিক অংশও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের দ্বারা একইভাবে বিপন্ন হচ্ছে। দখল করে নেওয়া হয় তাদের সহায়-সম্পদ। এগুলো দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। সংখ্যালঘুরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে অত্যাচারের শিকার, এটা অসত্য নয়। গারো, হাজং, সাঁওতালসহ সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকগুলোও অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়। তাদের জমি কেড়ে নেওয়াসহ বেশ কিছু নিপীড়নের ঘটনা গণমাধ্যমে আসে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিকারের ব্যবস্থাও দুর্বল।

একই প্রতিবেদনে ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ক্রমাবনতিশীল বলে উল্লেখ রয়েছে। যতটা দেখা যায়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। পাকিস্তান এমন কিছু করেছে কি না, জানা যায়নি। আর আমাদের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমনটা লক্ষ করা যায়নি। আমরা ব্যাপারটি চেপে যেতে চাইছি কেন, তা বোধগম্য নয়। পাকিস্তান প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্লাসফেমি আইন, ধর্মান্তরসহ নানাবিধ কারণে সে দেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। উল্লেখ্য, দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যা খুবই কম। হিন্দু ও শিখরা প্রায় সবাই ভারতে চলে গেছে। রয়ে গেছে খ্রিষ্টানরা। আছে শিয়া ও আহমদিয়ারা। দেশটি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন। দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের ফলে ধর্মীয় মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দিতে হচ্ছে এর মাশুল।

প্রতিবেদনের ভারতীয় অংশে সে দেশে হিন্দুত্ববাদের উত্থান, গো-হত্যা নিয়ে একটি চরম অসহিষ্ণু মনোভাব সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুসলমান, খ্রিষ্টান ও দলিতরা নিপীড়নের শিকার। সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু প্রাণহানির উল্লে­খও রয়েছে। ভারতের হাল আমলের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ নিয়ে সেখানকার গণমাধ্যমে অনেক বরেণ্য ব্যক্তি ক্রমাগত সতর্কবাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। তাঁদের একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার। অতি সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁর একটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘আনসারির কথা আমলে নিতে হবে’। উল্লেখ্য, ভারতের উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে মেয়াদান্তে বিদায় নেওয়ার সময় হামিদ আনসারি বলেছেন, ‘দেশটির মুসলমান নাগরিকেরা সেখানে নিরাপদ বোধ করে না।’

এ বক্তব্যে সরব ক্ষুব্ধ ভারতের বর্তমান শাসকদলের বেশ কিছু নেতা। কুলদীপ নায়ার বেদনার সঙ্গে আনসারির বক্তব্যের সমালোচকদের জবাব দিয়েছেন। বিষয়টি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভেবে দেখা দরকার বলেও তিনি নিবন্ধে উল্লেখ করেন। এতে আরও উল্লেখ রয়েছে, প্রায় এক দশক আগে গঠিত দিল্লি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজিন্দর সাচারের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, মুসলমানদের সঙ্গে দলিতদের চেয়ে খারাপ ব্যবহার করা হয়। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থানও অনেক নিচে। নায়ারের মতে, এটা শুধু বর্তমান সরকার নয়, বিভিন্ন সময়কার সরকারের অব্যাহত অবজ্ঞার ফসল। তাঁর নিবন্ধের শেষ কথা হলো, ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। গত সাত দশকের চর্চিত ধর্মনিরপেক্ষতা এভাবে মহাবিপদের মুখে পড়বে, তা সত্যই দুঃখের।’

ওপরের আলোচনা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের অবজ্ঞা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি শুধু বিশেষ একটি দেশের নয়, এটি বৈশ্বিক আর আঞ্চলিক তো বটেই। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, তাঁরা অন্য কোনো স্থানে বা দেশে সংগঠিত কোনো সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবরে প্রভাবিত হন না। তবে ব্যতিক্রমও কম নয়। কারও কারও মতে, উপমহাদেশের এ বিভাজন রেডক্লিফ রোয়েদাদ-সৃষ্ট। যদিও প্রাপ্ত তথ্যাদি একে পুরোপুরি সমর্থন করে না। অনেক আগেই এটা ছিল এবং দুঃখজনক হলেও এখনো আছে। ড. আকবর আলি খান তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইয়ের ধর্মনিরপেক্ষতা অধ্যায়ে এর বীজ যে কত গভীরে, সে বিষয়ে দুটো কাহিনির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। প্রথমটি ১৯৩১ সালে লিখেছিলেন স্বনামধন্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। শিরোনাম ‘নেড়ে’। অপরটি লিখেছেন প্রখ্যাত উদারমনস্ক ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী। ভারত উপমহাদেশে প্রধান দুটো সম্প্রদায়ের অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও এতে কপটতা আছে, এমনটাই দুটো কাহিনির প্রতিপাদ্য। আর তা দূর করতে হবে। এটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

সবশেষে যারা গবেষণাটি চালায়, সেখানকার অবস্থা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। এটা সবারই জানা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা। অন্য দেশ থেকে অভিবাসীরা গিয়ে আদিবাসীদের কার্যত কোণঠাসা করে নতুন এক সভ্যতা গড়ে তুলেছে। সে দেশের অর্থনীতির ভিত জোরদার করেছে আফ্রিকা থেকে জোর করে নিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রম। অথচ তারা আইনি সমান অধিকার পেয়েছে মাত্র অর্ধশতাব্দী আগে। তবে বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। নিরাপত্তাসংকটেও ভোগে। অভিবাসীদের দেশটিতে সংকটে ভোগে নতুন অভিবাসীরা। নাজি মতবাদে দীক্ষিত শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসীরা এখন নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করছে। দুর্ভাগ্যজনক, বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ‘সফলভাবে’ মার্কিন সমাজকে ভাগ করে ফেলেছে। তবে স্বস্তির কথা, সে দেশে সুবিবেচনাবোধসম্পন্ন একটি শক্তিশালী সিভিল সমাজ রয়েছে। তারা এ ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এসব বিবেচনায় বলতে হয়, সমস্যাটি বৈশ্বিক। তাই কোথাও যেন এরূপ না ঘটে, তার জন্য সন্ত্রাসবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক জোটের মতো সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জোটও গঠন করা দরকার।

সবশেষে বলতে হয়, বিশ্বের অন্য কোথাও যা-ই ঘটুক, আমাদের দেশে যাতে সব ধর্ম ও গোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্র সমানভাবে সুবিবেচনা করতে পারে, তার প্রতিও আমরা থাকব বিশ্বস্ত। এটাই আমাদের স্বাধীনতার চেতনা। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক জোট এ প্রচেষ্টাকে জোরদার করতে পারে।