জালালাবাদ থানার তৎকালীন ওসি শাহ হারুন ও তার সংক্ষিপ্ত আমলনামা

জালালাবাদ থানার তৎকালীন ওসি শাহ হারুন ও তার সংক্ষিপ্ত আমলনামা।

ছবির এই ভদ্রলোকের নাম শাহ হারুনুর রশীদ। তিনি বর্তমানে গোয়াইনঘাট থানার ওসি হিসেবে কর্মরত। অথচ ছাত্র—জনতার বিজয়ের পর ওই ব্যক্তির ওসির দায়িত্বে থাকার কথা নয়। বাড়ি সুনামগঞ্জে। শুনেছি তার বিরুদ্ধে সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকার জালালাবাদ থানার ভুক্তভোগীরা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ২০১৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াত দমনে এমন কোন হীন কাজ নেই ওসি শাহ হারুন করেননি। তিনি বিএনপি কর্মীদের কাছে মুর্তিমান আতংক আর চোর বাটপার চাদাবাজদের ছিলেন সহযোগী। নিচে তার কয়টি আকাম তুলে ধরছি। যেগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবহিত ছিলাম আমি। নিম্নে উল্লেখিত ব্যক্তিদের সাথে কথা বললে আরো নির্যাতনের করুন চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে আমার বিশ^াস।

পার্টির জন্য খাসি দিয়েও পার পাননি হাফিজ মেম্বার:
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিএনপি জামায়াত নেতাকর্মীদের থানায় ধরে এমন কিছু নির্যাতন করেছে মনে হলে এখনো গাঁ শিউরে উঠে। রাজনৈতিক মামলার ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলো ওসি শাহ হারুন। তৎকালীন টুকেরবাজার ইউনিয়নের মেম্বার হাফিজুর রহমান। সে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। একদিন সকালে ওসি হারুন তাকে ফোন দিয়ে বলেন, থানায় একটি পার্টি আছে, তোমাকে খাসি দিতে হবে। সে মামলার ভয়ে খাসির জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়ে পাঠায়। ওই টাকায় মন ভরেনি ওসি হারুনের। সন্ধ্যায় হাফিজ মেম্বারকে পুলিশ পাঠিয়ে থানায় নিয়ে যায়। পরে রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় ১ লাখ টাকা দিয়ে তাকে থানা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। এই শেষ নয় ২ দিন পর দোকান থেক হাফিজ মেম্বারের কলেজ পড়–য়া ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এবার ডিমান্ড ২ লাখ। একপর্যায়ে টাকা না দেয়ায় তাকে আর ছাড়ানো যায়নি। এখনো মামলা আদালতে হাজিরা দেয় সে।

মাছুম ভাই এর প্রতি নির্যাতন দেখে কেঁদেছিলেন অপর পুলিশ সদস্যরা:
মাছুম ভাই। বর্তমান কানাডা প্রবাসী। কট্টর বিএনপিকমীর্। পুলিশ পাঠিয়ে একদিন রাতে তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর চলে হুমকি দামকি। ওসি হারুন বলেন যদি ৩ লাখ টাকা দাও থানা থেকে ছেড়ে দেব। না দিলে থানায় বিএনপি জামাতের যত মামলা আছে সব মামলায় তোমাকে ঢুকিয়ে দিবো। মাছুম জানান তার কাছে টাকা নেই। ওসি দাবি করেন তুই জায়গা বিক্রি করে ৫০ লাখ পেয়েছিস, কে বলেছে তোর কাছে টাকা নেই। এরপর চলতে থাকে নির্যাতন। থানার পাশ^বতীর্ গ্রাম হওয়ায় অনেক পুলিশ সদস্যদের সাথে মাছুম ভাইয়ের পরিচয় ছিল। একপর্যায়ে ওসি হারুন নিজে মাছুম ভাইয়ে মাটিতে ফেলে বুকের উপর পা দিয়ে চাপ দিয়ে বলছিলেন টাকা দিবেন কিনা। এই নির্যাতন দেখে এক এএসআই নিজের কান্না থামাতে পারেননি। চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, স্যার আমরা এই এলাকায় থাকি। আমি জানি ও জায়গা বিক্রি করেনি। কোন টাকা নেই ওর কাছে কোথা থেকে দিবে? আমরা ওই এলাকায় জমি কিনে বাসা বাড়ি করেছি। আর এভাবে নির্যাতন করলে আমরা মুখ দেখাবো কি করে। প্লিজ স্যার নির্যাতন বন্ধ করেন। তখন ওসি হারুন ওই এএসআইকে হুমকি দিয়ে বলেছেন বেশি কথা বললে তোর চাকরি খেয়ে নিবো। অথচ ওসি ও এসআইয়ের বাড়ি সুনামগঞ্জের একই এলাকায়।

বিএনপির প্রার্থীর টাকা ব্যালটবাক্স ভরে নৌকার:
২০২৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার মূল দায়িত্ব ছিলো ওসি হারুনের উপর। সিলেট ১ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন খন্দকার আব্দুল মক্তাদির। দুই/তিন দিন আগ থেকে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের চাপ দিতে থাকে মুক্তাদির সাহেব বড় অঙ্কের টাকা না দিলে বিএনপির কাউকে ভোট কেন্দ্রের আশেপাশে পুলিশ দাড়াতে দিবেনা। টাকা দিলে ওসি হারুন ও তার ফোর্স নমনীয় থাকবে। অন্যদিকে মুক্তাদির ভাইয়ের মিডিয়া টিমে থাকায় আমি জানতাম তার সবকটি একাউন্ট আগে থেকে ব্লক করে দিয়েছিলো সরকার। চরম টাকার সংকটে ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে ওসি হারুনের চাপে স্থানীয় বিএনপি নেতারা টাকা ম্যানেজ করে ওসির হাতে দিয়েছিলেন। ফলাফল বিএনপির প্রার্থীর কাছ থেকে টাকাও নিয়েছিলো, উল্টো রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছিলো নৌকার ব্যালট দিয়ে। পরদিন জালালাবাদ থানায় বিএনপি নেতাদের টাকা দিয়ে খাসি পার্টিও করেছিলেন ওসি শাহ হারুন।

মনফর বাহিনীর উত্থান:
জালালাবাদ থানায় ওসির দায়িত্ব থাকাকালে চেঙ্গেরখাল নদীতে চলাচলকারী পাথর বালুর নৌকা থেকে চাঁদা তুলতে শুরু করে জালালাবাদ ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মনফর। এলাকার ছাত্রলীগের ছোট ভাই জাহেদসহ এলাকার সচেতন লোকজন এর প্রতিবাদ শুরু করেন। চাঁদাবাজি বন্ধে জালালাবাদ থানায় আসেন বিক্ষুব্ধ সচেতন ব্যক্তিবর্গরা। ওসি হারুন প্রথমে শুনেন কিভাবে চাদা তোলা হয়, এর পরিমান কত। এরপর মনফরের লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা উল্টো তাদের সেল্টার দিতে থাকেন। যারা প্রতিকার চেয়ে থানায় এসেছিলেন তাদের ম্যানেজ হওয়ার প্রস্তাব দেন ওসি নিজে। একপর্যায়ে ওসি হারুনের সেল্টারে এলাকায় মনফর বাহিনীর উত্থান ঘটে। একদিন বিক্ষুব্ধ কিছু ছত্র ভাই ও মুরব্বি দৈনিক সিলেটের ডাক এ আসেন। তাদের আশঙ্কা ছিলো থানার ওসি যখন ম্যানেজ হয়ে গেছে সাংবাদিকরাও ম্যানেজ হয়ে যেতে পারে। আমি সেদিন আশ্বস্ত করেছিলাম এলাকাবাসী পাশে থাকলে মনফর বাহিনী নিশে^স হয়ে যাবে। তবে শর্ত তোমরা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে থাকতে হবে। তারা কথা রেখেছিলো। ওসি হারুন মনফরের চাঁদাবাজির টাকায় ম্যানেজ হয়ে গেলেও তৎকালীন ওসি তদন্ত শাহ আলম ছিলেন এলাকাবাসীর পক্ষে। দাপুটে ওসি হারুন চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা যাবেনা বলে সাফ জানিয়ে দেয়। একপর্যায়ে সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থা হস্তক্ষেপ করে। এরপর একদিন মনফর চেয়ারম্যান কে গ্রেফতারের অনুমতি এসেছিলো থানায়। ওসি হারুন আর এড়াতে পারেননি। অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় মনফর বাহিনীর প্রধান মনফর। বর্তমানে মনফর বেঁচে নেই। সেদিন এই মনফর বাহিনীর উত্থান হয়েছিল ওসি হারুনের নেতৃত্বে।

ওসির পরিচয় যখন আওয়ামী লীগ নেতা:
দক্ষিণ সুরমা থানায় ওসির দায়িত্ব কালে কোন কারনে ঢাকা সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন জনতা। তখন হঠাৎ জনপ্রতিনিধির মতো সড়কে টেবিলে উঠে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে জনতাকে হুমকী দিয়ে বলেন, আপনারা হয়তো জানেন না আমি নিজেও একজন আওয়ামী লীগ নেতা। আমার নেতা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। উনারাই আমাকে সিলেটে নিয়ে এসেছেন। সড়ক অবরোধ তুলে না নিলে দেখে ছাড়বো। ওসি হয়ে সিরেটে এসে এমন মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছিলেন ওসি হারুন।
জালারাবাদ থানায় দায়িত্ব পালনকালে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। কেউ হামলা মামলার প্রতিকার চেয়ে কেউ থানায় এলে যেন তার স্বজন হলেও কোন বিএনপি জামাতের কর্মীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। কোন ভিকটিমের সাথে বিএনপি জামাতের কেউ চলে আসতেন দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতেন। ভিকটিমও হয়ে যেত বিএনপি জামাত।

ছাত্রজনতার বিজয়ের পর ওসি গোয়াইনঘাট থানার ওসি হিসেবে বদলী হয়ে এসেছেন শাহ হারুনুর রশীদ। চোরাচালানের মূল রুট এই থানা দিয়েই। শুনেছি সেই থানায় ফিটিং মামলা শুরু হয়ে গেছে। আল্লাহ গোয়াইনঘাট বাসীকে রক্ষা করুন।
জালালাবাদ থানায় থাকাকালে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আল্লাহ তাদেরও মনের আশা পূরণ করুক।