বাংলাকে শিরোনামে রেখে ইউরোপে প্রথম মানচিত্র প্রকাশিত হয় ১৬১৮ সালে। ত্যাবুলারাম জিওগ্রাফিকারাম কনত্রাকতারাম লিব্রি কোয়াতুউর নামের অ্যাটলাসে মানচিত্রটি এঁকেছেন ফ্লেমিশ মানচিত্রকর পেত্রো বারতিয়াস। মানচিত্রটি আঁকার সময় তিনি ব্যবহার করেছেন মানচিত্র বিশারদ পেত্রাস কায়েরিয়াসের ১৫৯৮ সালে তৈরি অ্যাটলাস কায়ের্ট থ্রেসুর। বাংলার জন্য সেই সময়টা সন্ধিক্ষণ। সুলতানি যুগের শেষ ও মোগল যুগের সূচনা। দাউদ খান কররানিকে ক্ষমতা থেকে ১৫৭৬ সালে সরিয়ে মোগলরা বাংলার পশ্চিম অংশ পদানত করলেও পূর্ব অংশ তখনো মুক্ত, বারোভুঁইয়াদের নিয়ন্ত্রণে। মানচিত্রের দিকে তাকালে সে বিবরণ স্পষ্ট বোঝা যায়। যশোর, বিক্রমপুর, শ্রীপুরকে চিহ্নিত করে কলকাতা থেকে আরাকান পর্যন্ত সে সীমানা যথেষ্ট প্রশস্ত। ব্রিটেন থেকে বাংলার প্রথম বিশদ মানচিত্র প্রকাশিত হয় জন থর্নটনের তত্ত্বাবধানে, আনুমানিক ১৬৭৫ সালে। মানচিত্রের ওপরের দিকে বড় করে ‘দ্য রিচ কিংডম অব বাংলা’ লেখা হয়েছে। সেখানে বাংলার সীমানায় পাটনা থেকে আসাম এবং ওড়িশা থেকে আরাকান পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সে মানচিত্রের দিকে তাকালে বাংলার আয়তন ও পরিধি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। বাংলার সেই সীমানা কমবেশি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। বাংলার মানচিত্র অখণ্ড পরিচিতি প্রথম চিহ্নিত হয় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মাধ্যমে। ঐতিহাসিক মুনশী রহমান আলী তায়েশ তার তাওয়ারিখে ঢাকা গ্রন্থে ইলিয়াস শাহকে বাংলার প্রথম সার্বভৌম ও স্বাধীন শাসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার সময়কার খচিত মুদ্রায় লেখা থাকত দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। মার্কিন ঐতিহাসিক রিচার্ড ইটনের লেখা ‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, ১২০৪-১৭৬০’ গ্রন্থের দাবি, আধুনিক বিহার, নেপাল, ওড়িশা ও আসাম অব্দি বিস্তৃত ছিল তার অভিযান। যদিও সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে চাকরি করতেন তিনি, ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর ১৩৩৮ সালে নিজেই অধিষ্ঠিত হন শাসনকর্তার মসনদে। কিন্তু তার চোখ কেবল সাতগাঁওয়ের মসনদে সীমিত ছিল না। দীর্ঘ যুদ্ধের পর আলাউদ্দীন আলী শাহের থেকে ১৩৪২ সালে অধিকার করে নেন লাখনৌতির সিংহাসন। তার প্রায় দুই বছরের মাথায় ১৩৪৪ সালে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন ত্রিহুতের ওপর। নেপালের তরাই অঞ্চলেও পরিচালনা করেছিলেন দুঃসাহসিক অভিযান; যদিও অঞ্চলটিকে রাজ্যভুক্ত করেননি। এইবার ইলিয়াস শাহ নজর দিলেন বাংলার পূর্বাঞ্চলে; ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে ১৩৫২ সালে সোনারগাঁও অধিকার করেন। আর এর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক এক ঘটনা ঘটল বাংলার ইতিহাসে—সমগ্র বাংলা একত্র হলো। ইলিয়াস শাহই প্রথম সাতগাঁও, লখনৌতি ও সোনারগাঁও অধিকার করে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। সালতানাতের নাম ‘বাঙ্গালাহ’ এবং অধিবাসীরা সম্বোধিত হয় ‘বাঙালি’ নামে। বাংলা পেল একটি অখণ্ড মানচিত্র। সেই মানচিত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ে গেছে।
চতুর্দশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফিফ ইলিয়াস শাহকে শাহ-ই-বাঙ্গালাহ ও সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ বিশেষণে ভূষিত করেছেন। বাস্তবিক অর্থেই ইলিয়াস শাহ ছিলেন সফল বিজেতা। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন ইলিয়াস শাহকে দমন করার জন্য বাংলা অভিমুখে অভিযান করেন; তিনি মুন্সিয়ানার সঙ্গে তার প্রতিরোধ করেন। ফলে ইলিয়াস শাহ স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। বাংলা ও দিল্লির সুলতানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপহার ও দূত বিনিময়ের মাধ্যমে দৃঢ় হয়। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের আমলে বাংলা যেন অনেকটা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই ছিল; কিন্তু ইলিয়াস শাহের সময়ে পরিণত হয় পরাশক্তিতে।
বাংলা যে পরাশক্তি হয়ে উঠেছে, তা ইলিয়াস শাহি সুলতানদের আচরণেই প্রকাশ পেতে থাকে। আদিনা মসজিদের শিলালিপি থেকে দেখা যায়, সিকান্দার শাহ নিজেকে সমগ্র আরব ও পারস্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন। সিকান্দার শাহের পরে ক্ষমতায় আসেন গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ। কবি হাফিজের সঙ্গে তার যোগাযোগ এখনো লোকমুখে ফেরে। আজম শাহ কামরূপ তথা আসাম জয় করে স্বীয় সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেন। তার আমলে বাংলার সঙ্গে চীনের মিং সাম্রাজ্যের সম্পর্ক গভীর হয়। সেই সময়কার মিং দূতের লেখায় পাণ্ডুয়ার দরবারের কথা উল্লেখ আছে। তার রাজনৈতিক আধিপত্য দিল্লি ও জৈনপুর থেকে দৃশ্যমান হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে বাংলার মানচিত্রে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহ ক্ষমতায় আসার পর আরাকানের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। অধিকারে আনেন চট্টগ্রাম ও মোয়াজ্জামাবাদ (বর্তমান সুনামগঞ্জ) অঞ্চল। এছাড়া ফাতেহাবাদ তথা বর্তমান ফরিদপুরও তার অধিকারে আসে। ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানীর দাবি, জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহ ত্রিপুরার কিছু অংশেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৈদেশিক নীতিতেও তার সক্ষমতা ছিল যথেষ্ট। হেরাতের তৈমুরীয় সুলতান শাহরুখ, চীনের মিং সম্রাট ইয়ুং লি এবং মিসরের মামলুক সুলতান আশরাফ বার্সবির সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মক্কাতেও তিনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বস্তুত সুলতানি বাংলা স্বাধীন পরাশক্তি হিসেবেই বৈশ্বিক পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেছে। এর একটা বড় উদাহরণ জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহের মুদ্রা। তিনি মুদ্রায় ‘খলিফাতুল্লাহ’ পদবি ব্যবহার করেন। খলিফা পদবি রাসুল-পরবর্তী সেসব শাসকই এতদিন নিয়েছেন, যারা মক্কা ও মদিনার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। সুলতান উপাধি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসক ব্যবহার করলেও খলিফার ব্যবহার ছিল সীমাবদ্ধ। উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানি আমলে খলিফা পদবির ব্যবহার দেখা গেছে। বাংলায় শাসকদের ‘খলিফা’ ব্যবহার তাদের শক্তি ও পরাক্রমের পরিচয়কেই উপস্থাপন করে।
সুলতান শামসুদ্দিন আহমদ শাহের সময়ে বাংলা ও কায়রোর মধ্যে নৌপথে যোগাযোগ হতো নিয়মিত। বিশেষ করে মসলার বাণিজ্য ছিল ব্যাপক। সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত মোয়াজ্জামপুর শাহি মসজিদ তার আমলে নির্মিত। সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ে খান জাহান আলী যশোর ও খুলনা অধিকার করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় ষাটগম্বুজ মসজিদ। তার সালতানাত ছিল পশ্চিমে ভাগলপুর, পূর্বে ময়মনসিংহ ও সিলেট, উত্তরে গৌড় ও পাণ্ডুয়া এবং দক্ষিণে হুগলিজুড়ে বিস্তৃত। ঢাকার বিনত বিবির মসজিদ তার আমলে নির্মিত। তার প্রায় ২৪ বছরের শাসনকালে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে স্থানীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতির। সুলতান রুকনউদ্দিন বারবক শাহের সময়ে ওড়িশার রাজা বাংলায় আক্রমণ চালান। যদিও তিনি শাহ ইসমাইল গাজির নেতৃত্বে সেই আক্রমণ প্রতিহত করেন। এরপর তিনি কামরূপ অভিযান পরিচালনা করে দখল নেন। দখল করেন উত্তর দিনাজপুরও। প্রচলিত আছে বারবক শাহ মিথিলাও জয় করেন এবং সেখানে নিযুক্ত করেন কেদার রায়কে। এছাড়া সুলতান ত্রিহুতের হাজিগঞ্জ দুর্গেও অভিযান চালান ও দখলে নেন। ইলিয়াস শাহি বংশের শেষ শাসক জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহের আমল অব্দি বাংলা সালতানাতের উত্তরপূর্ব দিকের সীমানা ছিল দামোদর নদী পর্যন্ত।
বাংলার মানচিত্রে পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি আসে মূলত সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে। ১৪৯৩ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন। জৈনপুরে তখন অবক্ষয় পর্ব চলছিল। ফলে সেখানকার সৈন্যরা তার বাহিনীতে যোগ দেয়ার কারণে তার শক্তি বেড়ে যায়। তিনি রাজা নিলাম্বরকে পরাজিত করে কামতা রাজ্য বা কামরূপের পশ্চিমাংশ দখল করে নেন। তার রাজ্য বিস্তৃত হয় হাজো পর্যন্ত, যা বর্তমানে গুয়াহাটির উত্তরপশ্চিমাংশ। মালদার শিলালিপিতে তার সেই বিজয়াভিযানের কথা উদ্ধৃত হয়েছে। মানচিত্রের সীমানা তখন সিলেট পর্যন্তই ছিল। সিলেটের গভর্নর গওহর খান মারা গেলে প্রতাপগড়ের রাজা সুলতান বাজিদ সিলেট দখল করে নেন। আলাউদ্দিন তার অন্যতম সেনানায়ক সরওয়ার খানকে পাঠান পুনরুদ্ধার করার জন্য। সরওয়ার খান সফলতা পান এবং সিলেটের নতুন গভর্নর হন তিনিই। সোনারগাঁওয়ে প্রাপ্ত খাওয়াস খানের শিলালিপি থেকে জানা যায়, ত্রিপুরার কিছু অংশও নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন হোসেন শাহ। সেই সময়ে আরাকান শাসক চট্টগ্রাম থেকে হোসেন শাহের শাসকদের সরিয়ে দিলে ১৫১৩ সালে হোসেন শাহ পরাগল খানের নেতৃত্বে সেনাদল প্রেরণ করেন। পরাগল খান ফেনি নদী পর্যন্ত এগিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র ছুটি খান সেই অভিযানকে কালাদান নদী পর্যন্ত এগিয়ে নেন। পর্তুগিজ কূটনীতিক টমি পিরেজ ১৫১০ সালে বাংলায় আসেন। বাংলার সীমান্ত বর্ণনার ক্ষেত্রে তার দাবি, ওড়িশার করমণ্ডলের সঙ্গে বাংলার সীমান্ত একদিকে, পূর্ব দিকে সীমান্ত আরাকানে। উভয় রাজাই বাংলার শাসককে কর প্রদান করেন। এদিকে কুচবিহার ও ত্রিপুরাও তার সাম্রাজ্যের সীমান্তেই; সেখানকার শাসকরাও তাকে কর দেন। টমি পিরেজের বাংলায় আসার সময় আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ক্ষমতায় ছিলেন। অর্থাৎ তখন বাংলার মসনদের শাসনের সীমান্ত দক্ষিণপূর্বে কালাদান নদী ও উত্তরপূর্বে আসাম যুক্ত ছিল।
হোসেন শাহ ছিলেন সম্প্রসারণবাদী। সেই নীতিকে অব্যাহত রাখেন তার পুত্র নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ। ১৫১৯ সালে তিনি ক্ষমতায় বসেন। তার আমলেই বাবর দিল্লি জয় করেন। বাবর নসরত শাহকে ওই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মোগল সাম্রাজ্য তার আমলেই বিহার পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিল; কিন্তু তিনি বাংলাকে স্বাধীন রেখেছিলেন। পরবর্তী শাসক ফিরোজ শাহ ও মাহমুদ শাহ ছিলেন তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এদিকে পর্তুগিজরাও যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে চট্টগ্রামে। সেই সময়েই মাহমুদ শাহকে পরাজিত করে বাংলা অধিকারে নেন সম্রাট শের শাহ সুরি। শের শাহের পর তার পুত্র ইসলাম শাহ সুরি ক্ষমতায় বসলে বাংলার সুলতান নিযুক্ত করা হয় মুহাম্মদ খান সুরিকে। ১৫৫৩ সালে ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর মুহাম্মদ খান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার আমলে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া আরাকান আবার বাংলায় যুক্ত হয়। চট্টগ্রাম ও বিহারও তার অধিকৃত হয়। কিন্তু ১৫৫৫ সালে তিনি আদিল শাহের সেনানায়ক হিমুর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। মুহম্মদ শাহ ও তার পুত্র গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর, উভয়ের আমলেই আরাকান থেকে মুদ্রা ‘টঙ্কা’ তৈরি হতো। সে সময়কার সুলতানি ক্ষমতা-প্রতিপত্তি কমতে থাকলেও বাংলার আয়তনে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি।
বাংলায় কররানি শাসন প্রতিষ্ঠা হয় ১৫৬৪ সালে। তাদের মানচিত্রেও ওড়িশার বড় অংশ ও কুচবিহার অন্তর্ভুক্ত ছিল। দাউদ খান কররানির সমাপ্তি তথা মোগল আমল পর্যন্ত বাংলার মানচিত্রে খুব বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ১৫৭৬ সালে দাউদ খান কররানির পতন ও মোগল সাম্রাজ্যের উত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলায় বিভক্তির একটা ধারা দেখা যায়। পশ্চিমাংশে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও পূর্বাংশ, তথা বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চল ছিল স্বাধীন বারোভুঁইয়াদের অধীনে। চট্টগ্রাম থেকে আসাম পর্যন্ত বাংলার বড় অংশ তখনো স্বাধীন। ইসা খান, মুসা খান, ফজল গাজি, কেদার রায়রা শাসন করেছেন। মোগল আমলে বাংলার বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবাদার ইসলাম খানের আমলে। মির্জা নাথানের লেখা বাহারিস্তান-ই গায়েবি ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের লেখা তুজুক-ই জাহাঙ্গীরীতে তার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি রাজমহল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন ১৬১০ সালে। বাংলার মানচিত্র আবার সম্প্রসারণ হতে থাকে মোগলদের অধীনে। পরবর্তী সুবাদার কাশিম খান চিশতির সময় স্বল্প সময়ের জন্য চট্টগ্রাম হাতছাড়া হলেও তিনি তার দখল ফিরিয়ে আনেন। তবে বড় সামরিক সাফল্য দেখা যায় সুবাদার ইবরাহিম খান ফতেহ জঙের সময়ে।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলার মানচিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় ম্যাথিয়াস ভন দে ব্রোকের সূত্র ধরে। ভন দে ব্রোক ছিলেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক। তিনি বাংলায় জরিপের উদ্যোগ নেন, যার নেতৃত্ব দেন ভন দে লিনেন, ১৬৬৬ সালে। সেই মানচিত্র ফ্রাসোঁয়া ভ্যালেন্তিনের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় ১৭২৬ সালে। মানচিত্রটি যখন তৈরি হয়েছে, তখন দিল্লিতে ক্ষমতায় আওরঙ্গজেব ও বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান। মানচিত্রটি বেশ বিস্তৃত। পাটনা, মুঙ্গের, রাজমহল থেকে সুতি পর্যন্ত আঁকা হয়েছে। দেখানো হয়েছে ভাগীরথী ও গঙ্গার গতিপথ। মুর্শিদাবাদ, কাশিমবাজার, পলাশী, বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং ওড়িশাও বাদ যায়নি। পদ্মা নদী ধরে দেখানো হয়েছে ফরিদপুর, হরিরামপুর, ইদ্রাকপুর। আঁকা হয়েছে সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকাও। সেই সময় পর্যন্তও বাংলার মানচিত্র বিস্তৃত আরাকান পর্যন্ত।মূলত ১৫৭৬ থেকে ১৭১৭ সাল পর্যন্ত বাংলা শাসিত হয়েছে মোগল সুবাদারদের মাধ্যমে। আওরঙ্গজেবের ভাই সুজা যে বাংলা থেকে নিজেকে মোগল সম্রাট দাবি করেছেন এবং আরাকানে নিহত হয়েছেন তা বাংলা ও আরাকানের ঘনিষ্ঠতাই তুলে ধরে। সুবাদার শায়েস্তা খান ও ইব্রাহিম খান, দুজনেই বাংলাকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। তবে ইবরাহিম খানের সময় বাংলায় প্রবেশ করে ইংরেজ ও ফরাসিরা। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম, চন্দননগরে ফোর্ট অর্লিন্স নির্মিত হয়; ডাচরা দুর্গ প্রতিষ্ঠা করে চুঁচড়ায়। ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। নওয়াবরা স্বাধীনভাবে শাসন চালাতে থাকেন। এ পর্যায়ে বাংলা, বিহার ও ওড়িশা একসঙ্গে শাসিত হতো। অর্থাৎ নওয়াবি বাংলার মানচিত্র বলতে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার সম্মিলিত মানচিত্রই বোঝানো হতো। মুর্শিদকুলী খানের সময় থেকে সুবাহদারি প্রকৃত অর্থে আর মোগল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এটি ক্রমে মসনদ বা সিংহাসনে পরিণত হয়, যাতে পরপর অধিষ্ঠিত হন সুজাউদ্দীন খান (১৭২৯-৩৯), সরফরাজ খান (১৭৩৯-৪০), আলীবর্দী খান (১৭৪০-৫৬) ও সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-৫৭)। এদের সবাই নিজেদের স্বাধীন শাসক মনে করলেও আইনগত ভিত্তির প্রয়োজনে অর্থের বিনিময়ে সম্রাটের কাছ থেকে সনদ সংগ্রহের চেষ্টা করতেন।
পলাশী বিপর্যয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফর আলী খানকে ‘নওয়াব’ উপাধি দিয়ে (আগের মতো নায়েব নাজিম বা সুবাহদার নয়) বাংলা, বিহার ও ওড়িশার মসনদে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার শাসনাধীন অঞ্চলের বিস্তৃতি আন্দাজ করা যায় ১৭৬০ সালে লন্ডন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত থমাস কিচিনের আঁকা মানচিত্র থেকে। সেখানে তিনি দক্ষিণপূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরপূর্বে আসামের রাঙ্গামাটি, উত্তরপশ্চিমে পাটনা ও সাসারাম এবং দক্ষিণপশ্চিমে ওড়িশার ভদ্রককে রাজ্যের ভেতরে দেখিয়েছেন। তবে দক্ষিণপশ্চিমে আরো বিস্তৃত জায়গা অজ্ঞাত হিসেবে মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যদিও নওয়াব উপাধি পরিণত হয়েছে ছোট ছোট জমিদারের মতো পদবিতে। তবে বাংলার আয়তনে বড়সড় পরিবর্তন ঘটেনি। এমন একটা উদাহরণ পাওয়া যায় ১৮৮০ সালে প্রকাশিত ‘টেক্সটবুক অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ বইয়ে প্রকাশিত বাংলার মানচিত্রে। ম্যাপ অব বেঙ্গল বলে যে অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি দক্ষিণপূর্বে চট্টগ্রাম, দক্ষিণপশ্চিমে ওড়িশার কটক, উত্তরপূর্বে আসামের শিবসাগর এবং উত্তরপশ্চিমে চম্পারণ।
ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাকে অবিভক্ত আকারেই শাসন করেছে। বঙ্গভঙ্গের সময় বাংলাকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও পূর্ববঙ্গ ও আসামকে একসঙ্গে রাখা হয়। সেই সময় এই অংশের (পূর্ববঙ্গ ও আসাম) পরিধিও নেহাত কম ছিল না। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের উত্তরে ছিল ভুটান, পূর্বে বার্মা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ। এর ভেতরে ছিল ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, ত্রিপুরা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, মালদা, কুচবিহার ও ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চল, আসামের গোয়ালপাড়া, কামরূপ, দারাং, নওগঞ্জ, শিবসাগর, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, কাছাড়, গারো পাহাড়, খাসি ও জৈন্তিয়া পাহাড়, নাগা এবং লুসাইয়ের পাহাড়ি অঞ্চল। চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, সুরমা ও আসাম উপত্যকা ছিল প্রশাসনিক কেন্দ্র। সে সময়ে বাংলার পশ্চিমাংশ বলতে ছিল বর্তমান বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা অঞ্চল। কিন্তু ১৯১২ সালে বাংলার দুই অংশ আবার একত্র হয় বঙ্গভঙ্গ রদের মধ্য দিয়ে। পূর্ববাংলা ও আসামের সঙ্গে একত্র হয় পশ্চিমাংশ। সেই মানচিত্র ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে বাংলা বলতে যে ভৌগোলিক অঞ্চলকে বোঝানো হতো, তা আরাকান থেকে ওড়িশা এবং আসাম থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। কখনো কিছুটা ছোট বা সংকুচিত হলেও খুব বেশি এদিক সেদিক হয়নি। এমনকি ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও বাংলার সেই পরিচয় তেমন পরিবর্তিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ভাগ হওয়া এর পুরনো বিস্তৃত মানচিত্রকে হঠাৎই ছোট করে ফেলে।
১৯৪৭ সালের ভাগের মধ্য দিয়ে বাংলা তার পরিচয়কে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তখন থেকে বাংলার মানচিত্র নতুন সীমানা ধরে আঁকা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের নির্ধারিত সীমানাই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার সার্বভৌম পরিচয় ও মানচিত্র হিসেবে তখন থেকে বাংলাদেশের মানচিত্রই প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু বাংলা এ মানচিত্রের মধ্য দিয়ে তার ঐতিহাসিক সীমানার বড় অংশ হারিয়েছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিবিদ বাংলার মানচিত্র অখণ্ড রাখার চেষ্টা করেও কেন সফল হননি, সেটা গবেষণার বিষয়। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে আক্ষেপ ফুটে উঠেছে আবুল মনসুর আহমদের বয়ানে। তিনি লিখেছেন, ‘বিদেশী ও নিরপেক্ষ লোকদের অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন, পার্টিশনে পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হইয়াছে। রেফারেন্ডামে বিপুল মেজরিটি পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও সিলেটের করিমগঞ্জ ভারতের ভাগে ফেলা, সমস্ত গৃহীত মূলনীতির বরখেলাফে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জিলা ভারতের ভাগে ফেলা, সুস্পষ্টতঃই ইচ্ছাকৃত পক্ষপাতমূলক অবিচার। কাশ্মীর ও ত্রিপুরার সাথে ভারতের কন্টিনিউটি রক্ষার অসাধু উদ্দেশ্যেই এ সব কাজ করা হইয়াছিল।’অখণ্ড বাংলার মানচিত্রের বড় অংশ হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কলকাতাকে ফেলে আসার ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৪ সালের ৩ জুন ন্যাশনাল পার্টি ঘোষণার সাতদিনের মাথায় সোহরাওয়ার্দী সরকার ঢাকাকে পূর্ব বাংলার রাজধানী করার ঘোষণা দেন। যেহেতু পূর্ব বাংলার শ্রমে ও ঘামে কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠা, তাই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তার পরও নাজিমউদ্দিন ও তার অনুসারীদের সন্দেহ ছিল কলকাতা পূর্ব বাংলায় যুক্ত হলে কলকাতাই হবে রাজধানী। কলকাতা ছাড়ার সিদ্ধান্তটি সোহরাওয়ার্দীর জন্য আত্মঘাতী হয়েছিল। কারণ কলকাতা ছিল সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির শক্তিশালী ঘাঁটি। গল্পের বড় অংশটা সামনে আসে সিলেটের গণভোটের পর। সে সময় অন্তত ১৭ জন সংসদ সদস্য যোগ দেন মুসলিম লীগে। সোহরাওয়ার্দীর সামনে তাদের প্রস্তাব ছিল, তিনি যেন তাদের মধ্য থেকে তিনজন মন্ত্রী ও তিনজন সচিব বানানোর ওয়াদা দেন। সেটা করলে তারা সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন দেবেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী নির্বাচনের আগে কোনো প্রকার ওয়াদা দিতে নারাজ ছিলেন। হতাশ হয়ে তারা খাজা নাজিমউদ্দিন ও অন্যান্য প্রার্থীকে একই প্রস্তাব দেন। সে নেতারা এমন সুযোগ সামনে পেয়ে লুফে নিলেন। আসলে সোহরাওয়ার্দীকে খোদ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আশ্বস্ত করেছিলেন, পূর্ব বাংলায় সংসদীয় নেতৃত্ব নিয়ে আপাতত কোনো নির্বাচন হবে না। সোহরাওয়ার্দীও তখন ব্যস্ত ছিলেন বাউন্ডারি কমিশনে মুসলিম লীগের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে। কিন্তু জিন্নাহর বক্তব্যের বাইরে গিয়ে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী খানের সহায়তায় সোহরাওয়ার্দীকে সরানোর পরিকল্পনা হচ্ছিল। লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ার্দীকে অপছন্দ করতেন; তিনি খাজা নাজিমউদ্দিনকে সমর্থন দিলেন। ফলে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমউদ্দিন আর ঢাকা হলো রাজধানী। কলকাতা নিয়ে তাদের সে অর্থে মাথা ব্যথা ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কলকাতা ছেড়ে আসার বিনিময়ে যে ক্ষতিপূরণের তোড়জোড় চলছিল, সেটাও ভেস্তে গেল। এ বিষয়ে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘সবগুলি মুসলিম সংবাদপত্রেই আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন ম্যাপ, চার্ট ও স্ট্যাটিসটিকস দিয়া কলিকাতা পূর্ব বাংলায় থাকার যুক্তি দিতেছিলাম। মুসলিম ছাত্রলীগ মিছিল ও জনসভা করিতেছিল। হক সাহেব পর্যন্ত এই আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী ও বেংগল পার্টিশন কাউন্সিলের মেম্বর সোহরাওয়ার্দী সাহেব দার্জিলিং-এ গভর্নর সার আর. জি. ক্যাসি সাহেবের সহিত আলোচনা করিয়া আমাদেরে এইরূপ আভাস দেন: চব্বিশ পরগণার বারাকপুর, বারাসত, তাংগর ও বশিরহাট পূর্ব-বাংলার ভাগে ফেলিয়া এবং কলিকাতা ও দার্জিলিং উভয় শহরকে উভয় বাংলার কমন শহর ঘোষণা করিয়া বাংলা বাটোয়ারা করিতে গভর্নর রাজি হইয়াছেন এবং সেই মতে ঊর্ধ্বতন মহলে প্রভাব বিস্তার করিবার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। গভর্নর কলিকাতাকে পূর্ব বাংলার অংশে ফেলিবার জোর আন্দোলন চালাইয়া যাইতেও সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে উপদেশ দিয়াছিলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নিকট হইতে এইরূপ আশ্বাস পাইয়া আমরা “কলিকাতা রাখ” আন্দোলন আরও জোরদার করি। বৃদ্ধ হক সাহেব পর্যন্ত এই আন্দোলনে আমাদের সাথে নামিয়া আসেন। কিন্তু কিছুদিন যাইতে-না-যাইতেই আমরা লীগ-নেতাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করিলাম। হক সাহেব ও শহীদ সাহেব প্রকাশ্যভাবে কলিকাতা রাখার আন্দোলন সমর্থন করিতেছিলেন। কিন্তু দেখা দেখা গেল কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ বাউন্ডারি কমিশনের সামনে হক সাহেব ও শহীদ সাহেবকে সওয়াল-জওয়াব করিতে না দিয়া যুক্ত প্রদেশের মি. ওয়াসিমকে উকিল নিযুক্ত করিলেন এবং জনাব হামিদুল হককে তাঁর সহকারী করিলেন। মুসলিম লীগের অনেকে ও ছাত্রলীগের সকলেই এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করিলেন। হক সাহেব খবরের কাগজে বিবৃতি দিলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হইল না। এমন সময়ে খাজা নাজিমউদ্দিন সাহেব নেতা নিযুক্ত হইবার পরদিন হইতেই প্রকাশ্যভাবে উল্টা বাতাস বহিতে লাগিল।’
যখন বিভাজন পরিকল্পনা হয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা বিভাজনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার ঘোষণা ছিল ভারতের বিভাজন অনিবার্য, তবে বাংলাকে অবিভাজ্য রাখা জরুরি। জিন্নাহও দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন তিনি ‘ছিন্নভিন্ন, ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তান’ কোনো অবস্থায়ই মেনে নেবেন না। তার পরও ব্রিটিশদের বাংলা বিভাজনের সিদ্ধান্ত মে মাসের মাঝামাঝি চূড়ান্ত হয় মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে। মাউন্টব্যাটেন তার দপ্তরের একমাত্র ভারতীয় কর্মকর্তা ভি পি মেনন এবং পণ্ডিত নেহরু ও সরদার প্যাটেলের মতো কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন বিষয়টি নিয়ে। Memoirs of Huseyn Shaheed Suhrawardy : With A Brief Account of His Life and Work গ্রন্থের দাবি অনুসারে, প্রাথমিকভাবে বাংলার মুসলিম লীগ বাংলা বিভাগের পরিকল্পনা মানতে অস্বীকার করে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার জন্য কাজ করতে বলেন। ওপর থেকে সম্মতি পেয়ে সোহরাওয়ার্দী বাংলার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, যাতে বিভাজন থেকে রক্ষা পেতে একটি পারস্পরিক সম্মত স্কিম তৈরি করা যায়। সে সময় সামনে তিনটা প্রস্তাব ছিল। মুসলিম লীগের অন্যতম প্রধান নেতা রাগিব আহসানের প্রস্তাব ছিল বাংলা, আসাম, ঝাড়খণ্ড ও ছোটনাগপুর নিয়ে একটা কনফেডারেশন গঠন করা। ফজলুর রহমানের প্রস্তাব ছিল বাংলা ও আসামের সুরমা পর্যন্ত কার্জন লাইন ধরে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলকে একত্র করা। সবিশেষ বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হামিদুল হক চৌধুরীর প্রস্তাব ছিল যুক্ত বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত অঞ্চল। তিনটা প্রস্তাবই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে পাঠানো হয়। যদিও জিন্নাহর জবাব পরে আর জানা যায়নি। তবে বাংলা ও আসামকে একত্র করাটা ছিল অধিকাংশের প্রত্যাশা। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম ও অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সদস্য শরৎচন্দ্র বসু বাংলাভাষী অঞ্চল নিয়ে একটা সার্বভৌম বাংলার নকশা সামনে আনেন, যার সীমানা হবে পূর্ণিয়া থেকে আসাম পর্যন্ত। তবে এর মধ্যে হিন্দু মহাসভা থেকেও বাংলা ভাগের দাবি ওঠে। সম্মতি দেন কংগ্রেসের সভাপতি আচার্য কৃপালিনী।
সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল খোলাখুলিভাবেই অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন দিল্লিতে। ২৮ এপ্রিল তিনি শরৎচন্দ্র বসু ও ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সেখানে খাজা নাজিমউদ্দিন, আবুল হাশিম ও ফজলুর রহমানও ছিলেন। গঠন করা হয় একটা সাব কমিটি। ১২ মে অখণ্ড বাংলা নিয়ে আলোচনা হয় মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। বাংলা থেকেও বিপুল জনসমর্থন তৈরি হয় যুক্ত বাংলার পক্ষে। সমালোচনা হয় হিন্দু মহাসভার বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে। ক্রমে বাড়তে থাকে সম্ভাবনা। ২০ মে একটা চুক্তি পর্যন্ত হয়ে যায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে বাংলাকে অখণ্ড রাখা নিয়ে। সোহরাওয়ার্দী সেটা জিন্নাহর কাছে পাঠান আর শরৎচন্দ্র বসু পাঠান গান্ধীর কাছে। এ সময়েই বদলে যায় ইতিহাসের বাঁক। সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ২৩ মে শরৎচন্দ্র বসুর চিঠির জবাবে গান্ধী বাংলাকে অখণ্ড রাখার প্রচেষ্টা থেকে দূরে থাকতে বলেন। বিভাজনের যে পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে, সেখানে কোনো বাধা দেয়া থেকে দূরে থাকতে বলেন শরৎচন্দ্র বসুকে। মূলত জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেলের মতো কংগ্রেসের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করেই গান্ধী তার অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন সে সময়, যা বাংলার ভাগ্যকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। গান্ধীর থেকে আসা এমন নির্দেশনায় শরৎচন্দ্র বসু মর্মাহত হন। ঘোষণা করেন, ভারত ভাগ যদি পাপ হয়, তাহলে বাংলা ভাগ আরো বড় পাপ। কিন্তু তার পক্ষে সে অর্থে হিন্দু নেতাদের কোনো সমর্থন পেলেন না। শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রাও দেরাদুনে সরদার প্যাটেলের কাছেও প্রস্তাব উত্থাপন করেন; কিন্তু প্যাটেল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্যাটেলের দাবি ছিল, এটা সোহরাওয়ার্দীর চাতুর্য। এটা করা হলে পশ্চিম বাংলাকে পাকিস্তানে যোগ দেয়ানো যাবে। সেটা হলে আসামও বাংলার সঙ্গে যুক্ত হবে। শেষমেশ প্যাটেল এ কথাও জানান, মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তার এ মর্মে গোপন সমঝোতা হয়েছে যে যদি ভারতকে ভাগ করতেই হয়, তাহলে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে কলকাতাকে পশ্চিম বাংলার অংশে রেখে। ফলে বাংলার মানচিত্রের ভাগ্য তখন নির্ধারিত হয়ে গেছে। যখন কংগ্রেস থেকে এভাবে প্রত্যাখ্যানের খবর এল, তখন জিন্নাহও বাংলার ভাগের ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করলেন।
তুলনামূলক কম আলোচিত হলেও পূর্ব বাংলা থেকে থেকে আসামের বাদ পড়াটাও বাংলার ইতিহাসে অন্যতম ট্র্যাজেডি। ইতিহাসের সব সময়েই আসাম ও বাংলা একটা আঞ্চলিক ইউনিট আকারে থেকেছে। বিশ শতকের প্রথম দিকে পূর্ব বাংলা থেকে বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন বাঙালি আসামে গিয়েছিল জীবিকার অন্বেষণে। ‘দ্য লাইন সিস্টেম ইন আসাম: আ স্টাডি অব দ্য রোল অব মাওলানা ভাসানী’ গবেষণাপত্রে বিমল জি দেব ও দিলীপ কুমার লাহিড়ী দাবি করেছেন, ‘১৯৪৪ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, কেবল ময়মনসিংহ জেলা থেকে আগত বাঙালীদের কারণেই আসাম সরকারের রাজস্ব আয় ৩০ বছরে বেড়েছিল প্রায় ৪৫ লাখ টাকা।’ তার পরও সে সময় আলোচনা ওঠে, অহমীয়রা আসামে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলবে। এমন পরিস্থিতিতেই লাইন প্রথার প্রবর্তন ঘটেছিল। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আসামের রাজনীতি সে সময় পরিষ্কার দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহ ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রভাবিত অংশটি বাঙালিদের স্বার্থ সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিল। দ্বিতীয় ধারার নেতৃত্বে ছিলেন কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বড়দলুই। সে সময় আসামে ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন জারি থাকলেও ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল মুসলিম লীগ। বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল প্রবাসী বাঙালি কৃষকের এবং তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা ভাসানী।
বিজয়ের ফলে প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহ। সাদুল্লাহ নিজে ছিলেন একজন অহমীয়। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির পক্ষ থেকে। দলের কর্মসূচি, বিশেষ করে লাইন প্রথা বাতিলের দাবি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করার মাধ্যমে তিনি মুসলিম লীগের সমর্থন পেয়েছিলেন এবং ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমেই তার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর দূরত্ব বাড়তে থাকে। স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে সাদুল্লাহ ও ভাসানীর মধ্যকার সংঘাত প্রকাশিত হয়েছে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে সাদুল্লাহর লেখা একটি চিঠিতে। সেখানে সাদুল্লাহ সরাসরি মুসলিম লীগ নেতা মওলানা ভাসানীকে অভিযুক্ত করেছেন। মওলানা ভাসানীও ১৯৪৪ সালে বড়পেটা সম্মেলনে দীর্ঘ ভাষণে ৫০ হাজার মানুষের সামনে প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লাহকে অভিযুক্ত করেন বেশ কয়েকটি অভিযোগে। ভাসানীর চোখে তখন সাদুল্লাহ আর বড়দলুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রচারণাও চালাতে থাকেন তিনি। সে সময় সাদুল্লাহর বিরোধিতা করার অর্থ ছিল অনিবার্যভাবে আসামে মুসলিম লীগের পরাজয় ও কংগ্রেসের ক্ষমতা লাভ। আর সেটাই সম্ভব হলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে। মুসলিম লীগের এ বিভক্তির সুযোগ নিয়েছে কংগ্রেস। উদয়ন মিশ্র তার Burden of History : Assam and the partition, unsolved Issues বইয়ে দাবি করেছেন, ‘কংগ্রেসের নীতি ছিল অভিবাসীবিরোধী নীতি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তারা অহমীয়দের পক্ষ নিয়েই তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে।’ ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। সরকার গঠন করে গোপীনাথ বড়দলুই। মাউন্টব্যাটেন যখন ভারত বিভাগের ছক কষছেন, তখন ক্ষমতা মুসলিম লীগের হাত থেকে কংগ্রেসের হাতে চলে যাওয়াটা বদলে দেয় আসামের রাজনৈতিক ভাগ্য। আসাম যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে। ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ের ৬-৭ তারিখ সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট আসাম প্রদেশের অংশ ছিল। সিলেটের তখন পাঁচটি মহকুমা—সিলেট, করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ। সিলেট ভারতে নাকি পাকিস্তানে থাকবে, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যই ছিল গণভোট, যা ‘সিলেট রেফারেন্ডাম’ নামে পরিচিত। গণভোটের ফলাফল ১২ জুলাই দিল্লি পাঠানোর পর ১৮ জুলাই ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী বিষয়টির বৈধতা দেয়া হয়। গণভোটে সিলেট পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৮ আগস্ট র্যাডক্লিফ সীমানা কমিশনের বিতর্কিত এক মতামতের ভিত্তিতে কয়েকটি থানাসহ করিমগঞ্জ মহকুমা আসামভুক্ত করা হয়।
মাউন্টব্যাটেনের এ সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত বাংলা ছিল বিস্তৃত, বিরাট এক ভৌগোলিক পরিচিতি। তার মানচিত্রেও সেটা ছিল স্পষ্ট। কলকাতা ও আসাম ছিল তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর সেই মানচিত্র সংকুচিত হয়ে গেল। বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যনিয়ন্তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি পরিস্থিতির গতিপথকে। বাংলার ইতিহাসে এটা একটা ট্র্যাজেডি যে বিগত সাত শতাব্দীতে বাংলাদেশের মানচিত্র কখনো এত ছোট ছিল না।