উসমান হাদির মৃত্যুর পর গণমাধ্যমের ওপর মব: আমরা কোন পথে হাঁটছি?

হাদির মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজপথ যেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, তেমনি উত্তাল হয়ে উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও। কিন্তু এই ক্ষোভ যখন যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের মতো শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের অফিসে মব হামলার রূপ নেয়, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা কি প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছি?

একটি মৃত্যুর ঘটনা যেকোনো সমাজে গভীর শোক ও ক্ষোভ তৈরি করতেই পারে। বিচার চাওয়া, সত্য উদঘাটনের দাবি তোলা—এসব একেবারেই যৌক্তিক। কিন্তু সেই ক্ষোভের নিশানা যদি হয় সংবাদমাধ্যম, তবে সেটি আর ন্যায়ের দাবি থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ।

প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার বাংলাদেশের এমন দুটি পত্রিকা, যারা বহু বছর ধরে ক্ষমতার সমালোচনা করেছে, মানবাধিকার নিয়ে লিখেছে, বিতর্কিত বিষয়েও কথা বলেছে। তাদের প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত থাকতেই পারে—গণতন্ত্রে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বিমতের জবাব কি মব দিয়ে, হুমকি দিয়ে, অফিস ঘেরাও করে দেওয়া যায়?

মব মানেই হলো ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের মৃত্যু। এখানে কেউ আর নিজে চিন্তা করে না, সবাই ভিড়ের সঙ্গে ভাসে। আজ যদি এই ভিড় একটি সংবাদমাধ্যমের দরজায় যায়, কাল তারা যেতে পারে যে কোনো ভিন্নমতাবলম্বীর ঘরেও। ইতিহাস আমাদের বারবার দেখিয়েছে—মব কখনো ন্যায়বিচার আনে না, বরং অন্ধকারকে আরও ঘনীভূত করে।

আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো, এই ধরনের হামলা সাংবাদিকদের মধ্যে আত্মসংযম নয়, বরং আত্মভয়ের জন্ম দেয়। সাংবাদিক যদি সত্য লিখতে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হন, তবে সমাজ সত্য থেকে বঞ্চিত হয়। মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া কোনো দেশই প্রকৃত অর্থে এগোতে পারে না।

হাদির মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, রিপোর্ট নিয়ে আপত্তি থাকতেই পারে। সেসব প্রশ্নের জবাব চাইতে হলে দরকার তথ্য, যুক্তি ও খোলামেলা বিতর্ক। কলাম লেখা যায়, পাল্টা বিশ্লেষণ করা যায়, প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করা যায়। কিন্তু মব কোনো সমাধান নয়—মব হলো সমস্যার বহুগুণ বৃদ্ধি।

আজ আমাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করা দরকার: আমরা কি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে ভিন্নমত মানেই শত্রু? যেখানে সাংবাদিকতা মানেই ঝুঁকি? নাকি আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই, যেখানে তীব্র মতভেদ থাকলেও তা প্রকাশ পায় সভ্য ও মানবিক উপায়ে?

হাদির মৃত্যুর বিচার চাই—এ দাবি ন্যায়সংগত। কিন্তু সেই দাবির পথে যদি আমরা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করি, তবে আমরা নিজেরাই ন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাই।

ভিড় নয়, বিবেকই হোক আমাদের পথপ্রদর্শক।