মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের চলমান বিক্ষোভ এবং উহা মোকাবিলার প্রয়াস যেইরূপে ক্রমেই সহিংস হইয়া উঠিতেছে, তাহাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হইয়া পারি না। আমরা দেখিয়াছি, সোমবার গাজীপুরে পুলিশের সহিত বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে রাসেল হাওলাদার নামে এক শ্রমিকের মৃত্যুও ঘটিয়াছে। এক সপ্তাহ ধরিয়া চলমান সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ মঙ্গলবার যেন আরও অগ্নিগর্ভ হইয়া উঠিল। গাজীপুরের মৌচাক বাজার এলাকায় একটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়াছে। অপরদিকে রাজধানীর মিরপুরে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকদের ওপর হামলা চালাইয়াছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী। অবস্থাদৃষ্টে এই আশঙ্কা অমূলক হইতে পারে না, মজুরি বৃদ্ধির নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হইবার যথেষ্ট ঝুঁকি রহিয়াছে।
স্বীকার করিতে হইবে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পোশাক শ্রমিকসহ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর যে নাভিশ্বাস উঠিয়াছে, তাহাতে মজুরি বৃদ্ধি অনিবার্য হইয়া পড়িয়াছে। বিশেষত পোশাক শ্রমিকদের সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা ঘোষণার পর গত পাঁচ বৎসরে দ্রব্যমূল্য কয়েক গুণ বাড়িয়াছে। কিন্তু নিম্নতম মজুরি বোর্ড প্রায় সাত মাস ধরিয়া তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণে মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে লইয়া আলোচনার পরও ঐকমত্যে পৌঁছাইতে পারে নাই। বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষ ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা প্রস্তাব করিলে মালিকপক্ষ উহার অর্ধেক বলিতেছে। ঐ সভার পরদিন হইতেই সংহিসতা ছড়াইয়া পড়ে। আমরা মনে করি, ঐকমত্য না হইলেও আলোচনা চালাইয়া যাইবার বিকল্প নাই। সহিংসতায় কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত বৈ লাভবান হইবে না। আমরা দেখিতেছি, শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরিয়া একের পর এক পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষিত হইতেছে। ইহাতে যদ্রূপ শ্রমিকের উপার্জন, তদ্রূপ কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হইতেছে।
স্মরণে রাখিতে হইবে, শিল্পাঞ্চলে সহিংসতা এমন সময় সূচিত হইয়াছে, যখন রাজনৈতিক সহিংসতা ঘনায়মান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উস্কানি কিংবা নাশকতা শ্রমিক বিক্ষোভের ন্যায্যতা ক্ষুণ্ন করিতে পারে। শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকিতে হইবে এবং ভাঙচুর ও জ্বালাও-পোড়াও যাহাতে আর না ঘটে, উহা নিশ্চিত করিতে হইবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বিচক্ষণতার সহিত শ্রমিক আন্দোলন মোকাবিলা করিতে হইবে। হঠকারিতার একটি স্ফুলিঙ্গই দাবানল সৃষ্টি করিতে পারে।
শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতি আমাদের আহ্বান– স্বীয় প্রস্তাবে অনড় না থাকিয়া উভয়কেই ছাড় দিতে হইবে। মালিকপক্ষকে যেইরূপ শ্রমিকের জীবনযাত্রার কথা ভাবিতে হইবে, শ্রমিকপক্ষকেও আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখিতে হইবে। শ্রমিকপক্ষের ২০ হাজার এবং মালিকপক্ষের ১০ হাজার টাকার প্রস্তাব দু্ইটির মাঝামাঝি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করিলে উভয়ের জন্য ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি হইতে পারে বৈ কি। অতীতেও যখন এই প্রকারে মজুরি নির্ধারিত হইয়াছে, এইবার অহেতুক বিলম্বে সহিংসতা ছড়াইয়া লাভ কী? দেশের বৃহত্তম রপ্তানি শিল্পে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে গড়িমসি উভয় পক্ষের জন্যই আত্মঘাতী হইতে পারে।