তাহলে কি আমরা জিয়াকে “বাঙ্গালী সেকুলার” বলতে পারি না?

পোশাক শিল্প খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত সমাজে প্রলয়ংকরী অর্থনৈতিক, যৌন, এবং সামাজিক বিপ্লব ঘটে যায়। নিম্নবিত্ত নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসে এবং অসহায় কাজের মানুষ এবং মনিবের সম্পর্ক রিনেগোশিয়েটেড হয়। গার্মেন্টসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে সেক্সুয়াল রেভুলুশন হয় সেটা নিয়ে খুব বেশি মানুষ কথা না বললেও, কিছু চিন্তক এটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারেন।

ভ্যাক্সিন। বাংলাদেশ পাবলিক হেলথে যে কয়টা সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে এটা একটা। শতভাগ ভ্যাক্সিনেটেড মানুষের দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের মানুষ রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রের দেওয়া টিকা গ্রহণ করে। পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এন্টি-ভ্যাক্স মুভমেন্ট খুব জোরেশোরে চালু আছে। সাধারণত এন্টি-ভ্যাক্স মুভমেন্টের একটা “রিলিজিয়াস” এঙ্গেল থাকে। অথচ তীব্র “রিলিজিয়াস” সেন্টিমেন্ট থাকার পরও বাংলাদেশে কোন এন্টি-ভ্যাক্স মুভমেন্ট নাই (রিসেন্টলি ইউটিউবের মাধ্যমে কয়েকজন এটা শুরু করার চেষ্টা করছে যদিও)।

বার্থ কন্ট্রোল। রাতারাতি বাংলাদেশ বার্থ কন্ট্রোলে এমন সফলতা অর্জন করে যে এখন সরকার বরং বার্থ রেট বাড়ানোর চিন্তা করছে। শ্লোগানেও এজন্য পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে যেখানে এক সন্তান গ্রহনকে উদ্বুদ্ধ করা হত, এখন দুই সন্তান গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। “দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভাল হয়” শ্লোগান থেকে সরে এসে পূর্বের “ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট” শ্লোগানে ফিরে যাওয়া হয়েছে। সত্তরের দশকে সাতের আশেপাশে থাকা বার্থ রেট নব্বইয়ের দশকেই ৩ এর কাছে চলে এসেছে। এখন সেটা দুইয়ের এদিকে ঘোরাঘোরি করছে।

বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির সিম্বল হিসাবে অনেকের কাছেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র গেঁথে গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজে এক সাংস্কৃতিক ও যৌন বিপ্লব এনে দিয়েছে এবং আজকের সোশাল মিডিয়ায় আমরা সেই বিপ্লবেরই বিবিধ প্রতিক্রিয়া দেখছি।

ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও অনেক ধরণের তর্ক আছে। তবে বাংলাদেশের গ্রামীন সমাজের অনেক গভীরে গ্রামীন ব্যাংক প্রবেশ করেছে। “রিলিজিয়াস” সেন্সিবিলিটির উত্তুঙ্গে থাকা একটা সমাজে গ্রামীন ব্যাংক তুলনামূলক সহজেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। গ্রামীন ব্যাংকের অর্থনৈতিক কার্যক্রমেরও থেকে গেছে বিবিধ সামাজিক ফলাফল যা এদেশের “রক্ষণশীল” সমাজের জন্য ভীতিকর। শুরু থেকেই গ্রামীন ব্যাংক সুদের পাশাপাশি লিঙ্গ-যৌনতা (বিশেষত নারীর ক্ষমতায়ন ও বিয়েবিরোধিতা), জন্মহারের মত অ-অর্থনৈতিক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে যার ফলে গ্রামীন ব্যাংকের বিরুদ্ধে এদেশে তুমুল গন আন্দোলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনটা হয়েছে ব্র‍্যাক এবং অন্যান্য এনজিওর বিরুদ্ধে। মোটাদাগে গ্রামীন ব্যাংক বেশ নিভৃতেই একটা সামাজিক বিপ্লব করতে পেরেছে।

উপরের পাঁচটা উদাহরণের সাথে জিয়াউর রহমান এবং তাঁর দল বিএনপির ভূমিকা মূখ্য। ইকোনমিক লিবারালাইজেশনের মাধ্যমে এবং বিনিয়োগের এন্তেজাম করে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি জিয়া তৈরী করেন। ভ্যাক্সিনেশন এবং বার্থ কন্ট্রোলও জিয়ার অবদান। জিয়াই ইউনুসকে আর দশটা প্রফেসর হওয়ার হাত থেকে হেফাজত করেন – ইউনুস হয়ে ওঠেন গ্রামীন ব্যাংকের মুহাম্মদ ইউনুস। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জিয়ার সম্পৃক্ততা নাই। বিএনপির আছে। ভারতে তরুনদের পড়তে যাওয়া ঠেকাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে বিএনপি। বিএনপি-জামাতের লোকদের হাত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ।

এখন, এই প্রতিটা উদ্যোগ কঞ্জার্ভেটিভ এংজাইটির যে নোডাল পোয়েন্টগুলি আছে সেগুলিকে টাচ করে। এক অর্থে বলা যায়, জিয়াই বাংলাদেশে “সেকুলারাইজেশন” করেছেন। কিন্তু এরপরও জিয়া কেন এত জনপ্রিয়? কেনই বা জেহাদী জজবায় ভরপুর দেশে এইসমস্ত নীতিগুলি শুধু ট্র‍্যাকশনই পায় নাই, বরং দৃশ্যমান উল্লেখযোগ্য কোন বিরোধিতা পর্যন্ত হয় নাই?

জিয়ার আগে বাংলাদেশে সেকুলারিজম বলতে ছিল শুধু কোলকাতাকেন্দ্রিক সেকুলারিজম। রবীন্দ্রনাথের পূজা আর্চনা করা পর্যন্তই সেই সেকুলারিজম সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু জিয়ার ফলে বাংলাদেশে “পাশ্চাত্য” সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটে। টেলিভিশন আসে। বিটিভির আধুনিকায়ন হয়। মানুষ রবীন্দ্রপূজা থেকে সরে এসে হার্ম প্রিন্সিপাল নিয়ে কথা বলতে শেখে। অবশ্য কোলকাতাপন্থীরা এতে খুশি ছিলেন তা বলা যায় না। বহুদিন পর্যন্ত দেশের বিতর্ক প্রতিযোগিতাগুলিতে কোলকাতাপন্থীরা যে বিষয়টা সামনে আনতেন তা হচ্ছে “আকাশ সংস্কৃতি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর” কিনা।

অথচ, জিয়া এবং বিএনপির পলিসিগুলি সামাজিকভাবে এবং তদসূত্রে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে “ইসলামপন্থী”দের। কিন্তু “ইসলামপন্থীদের” মধ্যে এসবের ব্যাপারে তীব্র কোন বিরোধিতা নাই। কেন?

জনপরিসরে ইসলামপন্থা-সেকুলারিজম নিয়ে যে সমস্ত চটুল কথা শোনা যায় তা থেকে মনে হয় যে ইসলামপন্থীরা আসলে আধুনিকতা বিরোধী বা “পাশ্চাত্য” প্রগতির বিরোধী। কিন্তু জিয়া প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এটা সত্য না। জিয়া ইসলামকে বাংলাদেশের কালচার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন – অনেকটা আবুল মনসুরের মত করে। সংবিধানে আল্লাহ-বিসমিল্লাহ ঢুকিয়েছেন। সেকুলারিজম বাদ দিয়েছেন। সেকুলারিজমের জন্য সংবিধানে সেকুলারিজম থাকা যে জরুরী না সেটা জিয়া সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন। আল্লাহ-বিসমিল্লাহর সাথেও যে সেকুলারিজমের নেসেসারি কোন সংঘর্ষ নাই সেটা বাংলাদেশের অনেক পণ্ডিত ও এক্টিভিস্ট না বুঝলেও জিয়া বোধহয় বুঝতেন।

ফলে, জিয়া কোন ধরণের এংজাইটি ও হোস্টিলিটি জেনারেট না করেই দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে পাশ্চাত্য প্রগতির দিকে আমাদেরকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছেন। শাফকাত রাব্বি এবং ফাহাম ছালামদের ভাষায় বলতে গেলে, আমরা মুজিব কোট ছেড়ে স্যুটেড-বুটেড হতে শিখেছি জিয়ার হাত ধরে। অথচ মুজিব কোট সাধারণত পাঞ্জাবীর ওপরেই পরে। মুজিব কোট জিনিসটাও আসলে কোটি – এটাও হুজুরদের প্রিয় পোশাক। হিসাব অনুযায়ী মুজিব কোটই বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রিয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আপনি একটা ইসলামপন্থী নেতা দেখাতে পারবেন না যে মুজিব কোট পরে। তবে স্যুটেড-বুটেড ব্যারিস্টার রাজ্জাক অনেক পাবেন।

জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে আনরেকগনাইজড অবদানটা এটাই- উনি একটা অল্টার্নেটিভ পাথ ফর সেকুলারাইজেশন দেখিয়েছিলেন যেটা সবাই চেপে যায়। শাহবাগীরা চেপে যায় শঠতার কারণে। ইসলামপন্থীরা চেপে যায় বিদ্যা-বুদ্ধির অভাবে – টেরই না পেলে তো চেপে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি?

জিয়ার বাংলাদেশে সুদ আছে, নারীর ক্ষমতায়ন আছে, ইন্ডিভিজুয়ালিজম আছে, লিবারেল ডেমোক্রেসি আছে, মেরিটোক্রেসি আছে, মদ ও যৌনতা আছে – শুধু নাই উতকট ইসলামবিদ্বেষ।

আসলে এটাই তো ইসলামপন্থীদের চাওয়া। পাশ্চাত্য সেকুলার ও আধুনিক হয়েছে তাদের “ধর্ম”কে সংস্কৃতি হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ দেশের পতাকা স্বাক্ষ্য দেয় খ্রিষ্টান চিহ্ন ও রঙ তাদের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ। খোদ ফ্রান্সের পতাকাও খ্রিষ্টান রঙে রঞ্জিত। অথচ, মুসলিমিস্তানে সেকুলারিজম ইসলাম সম্পর্কে এক বিশেষ ধরণের ঘৃণা ও হীনমন্যতাকে সাথে নিয়ে এসে। সেই হিসাবে জিয়া আমাদের সহী পাশ্চাত্য সেকুলারিজমে প্রবেশ করিয়েছেন যেখানে আমরা আর নিজেদের নিয়ে লজ্জিত নই। রুমডেটে গার্লফ্রেন্ডের রুপের ঝলকানি দেখে তরুনরা মাশাল্লাহ বহুত খুব বলবে – এটার সাথে যে সেকুলারিজমের কোন সংঘাত নাই সেটা জিয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কোন নোটেবল পলিটিশিয়ান বুঝেছেন বলে মনে হয় না।

এই অর্থে জিয়া আবার ইসলামপন্থীও। অন্যভাবে বললে ইসলামপন্থীরা আসলে সেকুলার। “পাশ্চাত্যের” ঠিক করে দেওয়া আধুনিকতায় প্রবেশের সময় নিজের এজেন্সি যে খানিকটা হলেও এক্সারসাইজ করার সুযোগ আছে – এটাই আসলে ইসলামপন্থীদের চাওয়া। মিলিটারির অনুষ্ঠানগুলিতে যতই নর্তকী আসুক না কেন, শুরুটা কোরান তেলাওয়াত দিয়েই হবে। ক্যাডেট কলেজগুলিতে ইসলাম পালন যতই কঠিন হোক না কেন, ইভনিং প্রেয়ারের উছিলায় মাগরেবের নামাজকে নাস্তিকের ওপরও চাপিয়ে দেওয়া হবে – এটাই তো আসলে ইসলামপন্থী ড্রিম। ব্রিটেনের পতাকায় ক্রস থাকবে, বাংলাদেশের পতাকায় সেতারা-হেলাল থাকবে। তারপর দুই দেশের সুন্দরিরা বিউটি কন্টেস্ট করে ঠিক করবে কোন সভ্যতা বিজয়ী – খ্রিষ্টান নাকি মুসলমান। ইসলামপন্থা তো আসলে এটাই।

ইসলাম-সেকুলার বাইনারি জিয়া ভেঙে দিয়েছেন দুটাকে এমনভাবে মিশিয়ে দিয়ে যেখানে এদেশের জনগোষ্ঠী আর জিয়ার বার্থ কন্ট্রোলে ইহুদী-নাসারার চক্রান্ত দেখে না। জামাতি শাহ আব্দুল হান্নানরা জেহাদি তামান্নায় ভারতবিরোধী জোশে নর্থ সাউথ প্রতিষ্ঠা করেন। ইউনুসকে সুদী কারবারি তকমাটাও জামাত দেয় না, “সেকুলার” আওয়ামী লীগই দেয়। সুদের ইসলামাইজেশন করার কাজটা জিয়া জানতেন, তাই জিয়া বরেন্য। কিন্তু এক্সপ্লসিটনেসের কারণে পট্টি-তসবি পরেও কিছু মানুষ পরিত্যাজ্য।